সংক্ষেপে মধ্যযুগীয় মুসলিম গ্রন্থাগারের উন্নতি ও সমৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা কর অথবা মধ্যযুগীয় মুসলিম গ্রন্থাগার সম্পর্কে যা জান লিখ || Discuss about the gradual development of Muslim Libraries in middle age

3

Question: সংক্ষেপে মধ্যযুগীয় মুসলিম গ্রন্থাগারের উন্নতি ও সমৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা কর অথবা মধ্যযুগীয় মুসলিম গ্রন্থাগার সম্পর্কে যা জান লিখ।

Discuss about the gradual development of Muslim Libraries in middle age.

ভূমিকাঃ

ইসলামের আবির্ভাব ও অবিশাস্য দ্রুত গতিতে এর বিস্তার খুবই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে ৬২২ খৃষ্টাব্দ থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েক দশকে আরব বিশ্বকে ছাড়িয়ে ইরাক থেকে মরক্কো পর্যন্ত এক বিশাল এলাকায় ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে। জ্ঞান সাধনাকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগে মুসলমানরা বিভিন্ন স্থানে গ্রন্থাগারে গড়ে তোলে।

মধ্যযুগীয় মুসলিম গ্রন্থাগার এবং এদের উন্নতি ও সমৃদ্ধিঃ 

মহানবী (স) জ্ঞানার্জনের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। মুসলমানগণ খুবই বইপ্রেমী ছিল। তদের এই বই প্রেম সম্বন্ধে মাইকেল এইচ হ্যারিস বলেছেন‘‘বিশ্বের ইতিহাসে আর খুব কম সময়ই বইকে এতটা শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখা হয়েছিল, বিশেষ করে সমাজের উচ্চ শ্রেণির মধ্যে’’।

নিচে মধ্যযুগীয় গ্রন্থাগার সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হল:

১. দামাষ্কাস লাইব্রেবী/ Library of Damascus: 

উমাইয়া শাসনামলে (661-750) দামেস্কে প্রথম ইসলামিক সাহিত্য ও সংস্কৃতির শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে হিসেবে গড়ে উঠে। উমাইয়া, মুয়াবিয়া, আব্দুল মালিক, হাজ্জাজ প্রমুখ ব্যক্তিগণ ছিলেন বিদ্যানুরাগী। এসকল বিদ্যানুগারীরা দামেস্কে Place Library ও House of Archive নামে দুটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। এ সকল গ্রন্থাগার মিশর, পারসিয়া , গ্রীস প্রভৃতি দেশের মেধাবি ছাত্র ও পন্ডিতবর্গের জন্য উন্মুক্ত ছিল। 
Current Damascus Library, Picture source : sana.sy

সংগ্রহঃ 
এই গ্রন্থাগারে আলকেমি, চিকিৎসাবিদ্যা এবং জোতিবিদ্যার পাশাপাশি সাহিত্য, দর্শন এবং ইসলাম ধর্মের নানান বিষয়ের বই সংগৃহিত ছিল। গ্রন্থাগারটির একটি অনুবাদ বিভাগ ছিল যার কাজ ছিল বিভিন্ন ভাষায় রচিত বই সমূহ আরবি ভাষায় অনুবাদ করা। এরিস্টটল এর রচনা সমগ্র এবং এরিস্টটল সম্পর্কে অন্যান্যদের মতামতও এখানে সংগৃহিত ছিল।

২. বাগদাদ লাইব্রেরী/ Library in Baghdad :
মধ্যযুগের মুসলমানদের সাহিত্য সাধনা ও জ্ঞান চর্চার জগতে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে আব্বাসীয় শাসনামলে (৭৫০-১০৫)। আব্বাসীয় খলিফারা জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চাকে দারুণভাবে উৎসাহিত করেন, যার ফলে তাদের রাজ্যে অনেক বিদ্যালয় ও গ্রন্থাগারের উৎপত্তি ঘটে। নবম শতকের দিকে বাগদাদে সংস্কৃতিক উৎকর্ষের শীর্ষবিন্দুতে অবস্থান করে ছিল এবং কমপক্ষে ৩০টি গ্রন্থাগার গড়ে উঠেছিল। বাগদাদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাগার সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলঃ 
(ক) বাইতুল হিকমা/Baytul Hikhmah:
আল মামুন (৮১৩-৮৩৩) এর শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রন্থাগারের ব্যাপক খ্যাতি অর্জিত হয়। মূলত বাইতুল হিকমা ছিল একটি বিদ্যালয় গ্রন্থাগার ও অনুবাদ ব্যুরোর সমন্বয়। এই গ্রন্থাগারে মুসলমান ছাড়াও হিন্দু, পারসি, ও খৃষ্টান ধর্মের লোক কর্মচারী হিসেবে কাজ করত। গ্রন্থাগারটি সমগ্র বিশ্বের পন্ডিতদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। 
House-of-wisdom, picture source : ancient-origin.net

সংগ্রহ:
মিশর, পারসিয়া, ইরাক , সিরিয়া ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বই সংগ্রহ করা হয়েছিল। এই গ্রন্থাগারের সবচেয়ে প্রাচীন সংগ্রহ ছিল হযরত মুহাম্মদ (স) এর পিতামহ আব্দুল মুত্তালিব এর একটি চিঠি যা চামড়ার উপর লিখিত ছিল। 
আব্দুল মুত্তালিব এর চিঠি  Picture Source : firestorebd.wordpress.com


(খ) নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরী:
আনুমানিক ১০৬৫ সালে বাগদাদে একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই হচ্ছে খাজা নিজামুল মুলক প্রতিষ্ঠিত বিশ্বখ্যাত নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। একটি ধর্মীয় শিক্ষাশ্রম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রথম থেকেই এখানে নানা বিষয়ে জ্ঞান দান করা হত। এই গ্রন্থাগারের বই সংগ্রহের দুটি উৎস ছিল। ১. ক্রয় ও ‍২. উপহার
ত্রয়োদশ শতকে মঙ্গল বাহিনি আক্রমনের মুখে নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ভবনসমূহ লুন্ঠিত হয় এবং এটি পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত চালু ছিল। 
 
নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরী Picture : archnet
(গ) মুনতানসিয়া মাদ্রাসা লাইব্রেরী:
খলিফা মুসতানী বিল্লাহ ১২২৭ সালে বাগদাদের পূর্ব পাশে এর ভিত্তি প্রস্তর করেন এবং এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ছয় বছর পর । প্রতিষ্ঠানটির উদ্বোধনী দিনে খলিফা মুসতানী বিল্লাহ ১৬০টি উটের পিঠে বোঝায় করে তার মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য প্যালাস লাইব্রেরী থেকে এখানে নিয়ে আসেন। 

সংগ্রহ :
এই গ্রন্থাগারটির বইয়ের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০, ০০০ । ইবনে বতুতার মতে অনেক প্রসিদ্ধ পন্ডিত ও ভ্রমণকারীরা গ্রন্থাগারটি পরিদর্শন করেন। 
(ঘ) পারসিয়া লাইব্রেরী:
পারসিয়া এর প্রতিটি নগরীতে গ্রন্থাগার ছিল। কবি Ibn Hamdan (935) নগরীতে একটি শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তোলেন যেখানে জ্ঞানের প্রায় সকল প্রকার বই সংগৃহিত ছিল। এই গ্রন্থাগার সকল শ্রেণির জন্য উন্মুক্ত ছিল এবং গরীব-মেধাবী ছাত্রদের এখানে বিনামূল্যে কাগজ প্রদান করা হত। 
(ঙ) কায়রো লাইব্রেরী:
মিশরে ফাতেমীয় খলিফারা দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে কায়রোতে সংস্কৃতির এমন একটি কেন্দ্র গড়ে তোলেন, যেটি সে সময়কার বিশ্বে অপ্রতিদন্বী রূপে আবির্ভূত হয়। খলিফা Al-Aziz (988) সালে কায়রোতে সর্বপ্রথম একটি গ্রন্থাগার স্থাপন করেন । এতে বইয়ের সংখ্যা ছিল কমপক্ষে ১ লক্ষ। এর মধ্যে স্বর্ণ ও রৌপ্যখচিত ২৪০০ কোরআন শরীফ ছিল। প্রতিটি গ্রন্থাগারের জন্য নিদিষ্ট ক্যাটালগ ছিল। এছাড়া গ্রন্থপঞ্জি প্রনয়ণ তাদেরই অবদান। 

(চ)  স্পেনে লাইব্রেরী :
স্পেনেও মধ্যযুগে মুসলিম সভ্যতার জ্ঞান চর্চার ব্যাপক বিকাশ ঘটে। কর্ডোভাতে একটি প্রসিদ্ধ মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। 
এছাড়াও বৃহৎ রাজকীয় গ্রন্থাগারের বইয়ের সংখ্যা ছিল 4 লক্ষ। খলিফা আল হাকিম 961 থেকে 976 খ্রিস্টাব্দ তার গ্রন্থাগারে চাকরি দিয়েছিলেন যারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে পান্ডুলিপি সংগ্রহ করত এবং পুস্তক ক্রয় করত। দশম শতকে স্পেনে সর্বমোট 70 টি গ্রন্থাগার ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: 
1.    Cordoba Library 
2.    Seville Library 
3.    Malaga Library ইত্যাদি। 

(ছ) দিল্লিতে লাইব্রেরী :
ভারতের দিল্লি মধ্যযুগে মুসলমানদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। আজমীর শরীফ মুসলমানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর এই মুসলিম শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 

বস্তুত মধ্যযুগীয় মুসলিম গ্রন্থাগার সমূহতে বিভিন্ন বিষয়ের উপর অনেক সংগ্রহ ছিল। বিভিন্ন ভাষায় রীতি বিভিন্ন ধর্মীয় সংগ্রহ, সংস্কৃতি, হিন্দু, মহাকাব্য, প্রেম, কবিতা সহ জীবনচরিত এবং কাল্পনিক বিজ্ঞান ছিল উল্লেখযোগ্য। বই সংগ্রহ ও পড়া ছাড়াও মধ্যযুগীয় মুসলিম গ্রন্থাগারগুলোর সেমিনার ও ছোট কামরা গুলোতে আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক চলত। 

মধ্যযুগের মুসলিম গ্রন্থাগারসমূহ ধ্বংসের কারণ:
১. আত্নকলহ:
দ্বাদশ শতকের গোড়ার দিকে প্রাচ্য এলাকার বেশ কিছু মুসলিম রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি অঙ্গনেও বেশ কিছু বিপর্যয় লক্ষ্য করা যায়। আত্মকলহ এবং আয়েশী জীবন-যাপন মুসলমানদের ধ্বংস ডেকে আনে।

২. খৃষ্টান কমোডর দ্বারা:
খৃষ্টান কমোডর কৃর্তক পুন: আক্রমন ও লুন্ঠন গ্রন্থাগারগুলোর ধ্বংস কার্যকে আরও ত্বরাণ্বিত করে। বারবার আক্রমন করে তারা ব্যাপক ধ্বংস সাধন করে।

৩. প্রাকৃতিক বিপর্যয়:
প্রাকৃতিক বিপর্যয় মুসলিম গ্রন্থাগার গুলোর ধ্বংসের প্রধান কারণ। বন্যার পানিতে প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি আগুন দ্বারাও ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ১২৫৭ সালে মদিনার বৃহত্তম ইসলামী গ্রন্থাগার বজ্রপাতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

৪. মঙ্গলদের আক্রমন:
মঙ্গল হায়াল চেঙ্গিস গোষ্ঠীর দুর্বত্ত দল ১২৬৮ সালে যে আক্রমন চালায় তা ছিল অত্যন্ত নির্মম। তারা প্রায় ৩৬টি গ্রন্থাগার ও প্রায় একশত ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারসহ বাগদাদ ও দামেস্কের অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাগার গুলো ধ্বংস করে দেয়। শত শত বছরের সঞ্চিত ধন-সম্পদ ও পুঞ্জিভূত জ্ঞান ভান্ডার লেলিহান অগ্নিশিখা হয়ে বাগদাদের আকাশে বাতাসে উড়ে বেড়ায়।

উপসংহার :
সার্বিক আলোচনার পরিপেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, মধ্যযুগীয় মুসলিম গ্রন্থাগার আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার মান উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রেখেছে। সে সময়কার গ্রন্থাগারের বিলুপ্তি না ঘটলে বিংশ শতকের আধুনিক বিশ্ব আরও অনেক এগিয়ে গেতে পারত এবং মুসলমানদের জ্ঞান চর্চার পথ আরও সুগম হত।

রফিক আজাদ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


You may Also Like

Post a Comment

3Comments
Post a Comment