শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কেন ঘোষণা করেন? ছয় দফার ধারা ও গুরুত্বসমূহ আলোচনা কর।

0

প্রশ্নঃ শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কেন ঘোষণা করেন? ছয় দফার ধারা ও গুরুত্বসমূহ আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ
৬ দফা উত্থাপনের ফলে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী শাসকবর্গকে এক চরম রাজনৈতিক সংকটে ফেলে দিয়েছিলেন যা মোকাবেলা করার মত বাস্তব শক্তি তাদের হাতে ছিলনা। তাই ৬ দফা স্বায়ত্বশাসনের দাবি মোকাবেলা করতে গিয়ে ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কজনক পরাজয়ের স্বাদ তাদের গ্রহন করতে হয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ঘোষণা করার কারণঃ
সামাজিক বৈষম্যঃ
 প্রথমত উর্দুকে তারা রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস নেয় রে  তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নিলেও একে ইসলামীকরণ করার জন্য কখনও রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রয়াস নেয়;  ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ জিন্নাহ পূর্ববাংলায় প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে আসেন সমগ্র পূর্ববাংলার মানুষ যখন তার নিকট থেকে আশার বাণী শােনার জন্য উদগ্রীব তখন তিিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জনাকীর্ণ জনসভা সদম্ভে ঘােষণা করেনUrdu, and urdu shall be the state language of Pakistan, এমন কি পরবর্তী ২৪ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন কে পাকিস্তানের শত্রুদের কারসাজি বলে মন্তব্য করেন


রাজনৈতিক বৈষম্যঃ
পাকিস্তানের শাসকবর্গ ১৯৩৫ সালের ভারত  প্রনিত আইনের ত্রুটির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে একেবারে গোড়ার দিক থেকেই পূর্ববাংলাকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন করে ফেলে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ পূর্ববাংলায় বাস করলেও রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপন করে প্রায় সকল রাজনৈতিক পদগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়োগ দেয়া হয়।  ১৯৪৮ সালে Pakistan Provincial Constitution (3rd Amendment) Order জারীর মাধ্যমে প্রদেশের ওপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করা হয়। এতে প্রদেশসমূহ রাজনীতিহীন হয়ে পড়ে

সামরিক ক্ষেত্রে বৈষম্যঃ
পাকিস্তানে সামরিকশাসন জারীর পর প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পায়যেমনঃ  
চাকুরির ক্ষেত্র
পূঃ পাকস্তান
পশ্চিম পাকিস্তান
সেনাবাহিনীতে
14
894
নেভিতে
7
593
বিমান বাহিনীতে
60
640
ফরেন সার্ভিস ক্যাডার
50
190
স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান
236
515

শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য
১৯৪৭ সালে পূর্বপাকিস্তানে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বেশি ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে ১৯৪৮ - ৫৫ সময়কালে ব্যয় করা হয়েছিল ১৫৩০ কোটি টাকা আর পূর্বপাকিস্তানে ব্যয় করা হয়েছিল ২৪০ কোটি টাকা।
উচ্চশিক্ষার জন্য যে সকল স্কলারশিপ পাওয়া যেত তার কোনটিই পূর্বপাকিস্তানী ছাত্রছাত্রী কিংবা গবেষকগণ পেত না, সবই পশ্চিম পকিস্তানীদের জন্য বরাদ্দ দেয়। হত

অর্থনৈতিক বৈষম্যঃ
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার সময় যে ৩৮ টি শিল্প কল-কারখানা লাভ করেছিল তার মধ্যে পূর্ববাংলায় ছিল ২০ টি এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ১৮ টি। কিন্তু যতই দিন যেতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প কলকারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও   পূর্ব পাকিস্তানের তেমন উল্লেখযােগ্য কলকারখানা গড়ে উঠেনি ।।
1947-55 সময়কালে উভয় অংশে কেন্দ্রীয় সরকার যে অর্থ ব্যায় করেছিল তা নিম্নরূপঃ
ব্যায়ের খাত
পশ্চিম পাকিস্তান (মিলিয়ন টাকা)
পূঃ পাকিস্তান (মিলিয়ন) টাকা
আর্থিক সাহায্য
10,000
1260
মূলধন ব্যয়
2100
620
অনুদান
540
180
শিক্ষাখাত
1530
240
বৈদেশিক সাহায্যের বরাদ্ধ
730
150
মোট
19550
2550

৬ দফার ধারাসমূহঃ
প্রস্তাব এক : শাসনতান্ত্রিক কাঠামো রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমনি হতে হবে যেখানে পাকিস্তান হবে ফেডারেশন ভিত্তিক রাষ্ট্র সংঘ এবং এর ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব আইন পরিষদের ক্ষমতা হবে সার্বভৌম এবং এই পরিষদও নির্বাচিত হবে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারণের সরাসরি ভোটে
প্রস্তাব দুই : কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবলমাত্র দুটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে যথা-দেশরক্ষা বৈদেশীক নীতি অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।
প্রস্তাব তিন : মুদ্রা অর্থ সম্বন্ধিয় ক্ষমতা মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারে
() সমগ্র দেশের জন্য দুইটি পৃথক অথচ অবাধে বিনয়োগযোগ্য মুদ্রা চালু থাকবেঅথবা,
() বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্য একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে করে পূর্বপাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয় ক্ষেত্রে পূর্বপাকিস্তানের জন্যে পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভের পত্তন করতে হবে এবং পূর্বপাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক অর্থ বিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে
প্রস্তাব চার : রাজস্ব, কর শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা ফেডারেশনের অঙ্গরাষ্ট্রগুলির কর বা শুদ্ধ ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবেনা। তবে প্রয়ােজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গরাষ্ট্রগুলাের রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলির সবরকম করের ক্ষমতা থাকবে। শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত।হবে।
প্রস্তাব পাঁচ ; বৈদেশীক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা
() ফেডারেশনভূক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রের বহির্বাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে।
() বহির্বানিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশীক মুদ্রা অঙ্গরাষ্ট্রগুলির এখতিয়ারধীন থাকবে
() কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশীক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিই মিটাবে
() অঙ্গরাষ্ট্রগুলির মধ্যে দেশজ দ্রব্যাদির চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা কর জাতীয় কোন বাধা নিষেধ থাকবে না।
() শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্য প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্ব-স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের
ক্ষমতা দিতে হবে।
প্রস্তাব ছয় : আঞ্চলিক বাহিনীর গঠনের ক্ষমতা
আঞ্চলিক সংহতি শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে স্বীয় কর্তাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন রাখার ক্ষমতা দিতে হবে

৬ দফার গুরত্বঃ
. শোষণের পরিসমাপ্তির প্রতিশ্রুতি শেখ মুজিব -দফাকে আমাদের বাঁচার দাবী -দফা, বলে উল্লেখ করেছেন। পৃথক মুদ্রাব্যবস্থা, কর রাজস্ব নির্ধারণ আদায়ে এদেশের এখতিয়ার, বিদেশে বাণিজ্য প্রতিনিধি প্রেরণ বাণিজ্য চুক্তি করার অধিকার বাস্তবায়ন করা সম্ভব।হলে এদেশের ভাগ্য এদেশবাসীই নির্ধারণ করতে সক্ষম হত।এবং শোষণের পরিসমাপ্তি হবে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের বহি:প্রকাশ: -দফা ছিল একটি ভারসাম্যমূলক দাবীর সমষ্টি যার মধ্যে দেশের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের পূর্ণ স্বাধীন বিকাশের প্রতিশ্রুতি ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকবর্গ শুধুমাত্র বাঙালি হওয়ার কারণেই পূর্বপাকিস্তানীদের সকল ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকারের পরিণত করেছে। এরফলে তাদের উপর বিজাতীয় শাসন শোষণের চিত্রটি তারা স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করে। এরফলে এক অভূতপূর্ব জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে।
স্বায়ত্তশাসন দাবীঃ ইতোপূর্বে অনেকেই পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের স্পষ্ট কোন রূপরেখা কেউ উপস্থাপন করতে পারেন নি। -দফার মধ্য দিয়ে। স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্রগুলিকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।

আওয়ামীলীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি:
 -দফার পর আওয়ামীলীগের তরুণ নেতৃত্ব একে এক জনপ্রিয় সংগঠনে পরিণত করে। শেখ মুজিব জনগণের মনের কথাগুলোই -দফার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন। এর ফলে আওয়ামীলীগ অতি দ্রুত একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়।
স্বাধীনতার বীজ:
-দফা বাস্তবায়িত হলে বাঙালি জাতি একটি পৃথক সত্তা নিয়ে বেড়ে উঠতে সক্ষম হবে। বাঙালির উপর পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রকার কর্তৃত্বের অবসান ঘটবে। ফলে অনেকে মনে করেন -দফা ছিল নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে স্বাধীনতা অর্জনের পদক্ষেপ স্বরূপ। বঙ্গবন্ধু নিজেও মুজফফর আহম্মেদ রুহুল কুদ্সকে বলেছিলেন যে -দফা আসলে এক দফারই ভিন্ন প্রকাশ।
১৯৭০ এর নির্বাচনে প্রভাব:
-দফা দাবীকে স্তব্ধ করার জন্যই পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮ সালে আগরতলা মামলা দায়ের করে শেখ মুজিবকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলাে। বাংলার জনগণ গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে এর জবাব দান করে। এরফলে পাকিস্তান সরকার ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। আওয়ামীলীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে -দফার প্রতি রেফারেন্ডাম বলে ঘােষণা করে।


Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)