1970 সালের নির্বাচনের পটভূমি, ফলাফল, গুরত্ব ও তাৎপর্য বর্ণানা কর
ভূমিকাঃ
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন ছিল অবিভক্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রের সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত প্রথম ও সর্বশেষ নির্বাচন | প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের এ নির্বাচন বাঙালি জাতীয়তাবোধ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে| স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ১৯৭০ সালের এ নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম|
নির্বাচনের পটভূমিঃ
শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ১০ই মার্চ রাওয়ালপিভিতে সর্বদলীয় গোল টেবিল বৈঠকে পার্লামেন্টারী পদ্ধতি প্রবর্তন ও প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন প্রস্তাবে আইয়ুব খান সম্মতি প্রদান করেন। উক্ত বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ৬-দফা ও ১১-দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব পেশ করে বলেন“এই বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি আমার আবেদন, তাঁরা যেন মুক্ত মন ও উদার হৃদয় নিয়ে এগিয়ে আসেন, ভাতৃত্ববোধ ও জাতীয় মনোবল নিয়ে দেশের সামনে আজ যে ভয়াবহ সমস্যা দেখা দিয়েছে অর্থাৎ অর্থনৈতিক ন্যায় বিচারের সমস্যার সমাধানের একমাত্র উপায় হিসেবে যে ফেডারেল পরিকল্পনা পেশ করা হয়েছে তা গ্রহণ করতে এগিয়ে আসেন। অর্থনৈতিক অবিচারের প্রসঙ্গই বর্তমান সমস্যাসমূহের প্রধান উৎস। আসুন আমরা তা অপসারিত করি, আসুন আমরা সমস্যার মূলে। হস্তক্ষেপ করি। এই মৌলিক সমস্যাসমূহের উপলদ্ধিকে এড়িয়ে যাওয়ার যে কোন রকম চেষ্টা হলে তাতে আমাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে।” দেশের এই রূপ পরিস্থিতিতে জেনারেল আইয়ুব খানের উপর সামরিক অফিসারগণ চাপ সৃষ্টি করেন। উপায়ান্তর না দেখে তিনি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ক্ষমতা হস্তান্তর পত্রে উল্লেখ করেন, “......দেশের সমুদয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও নিয়মতান্ত্রিক কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ অচল হইয়া পড়িয়াছে..........তাই আমি পাকিস্তানের দেশরক্ষা বাহিনীর হাতে পূর্ণ কর্তৃত্ব ন্যাস্ত করিয়া যাওয়ার সাব্যস্ত করিয়াছি।” ১৯৬৯ সালে ২৫ শে মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করে সামরিক শাসন জারি করেন। সামরিক শাসন জারি সপ্তাহখানেকের মধ্যে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আইনগত কাঠামো আদেশ জারি করেন। আইনগত কাঠামে আদেশ অনুযায়ী ইয়াহিয়া খান প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটে জাতীয় পরিষদ ও পাকিস্তানের ৫ টি প্রাদেশিক পরিষদের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর ঘোষণা করেন।
নির্বাচনের ফলাফলঃ
জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ৩৯.২% ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান অংশের জন্য বরাদ্দ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি (১৬০ টি সাধারণ আসন + ৭ টি সংরক্ষিত মহিলা আসন) আসন লাভ করে | অবশিষ্ট ২ টি আসনের মধ্যে ১টি পান সি, ডি, পি, প্রধান নুরুল আমিন এবং অপরটি পান নির্দলীয় প্রার্থী পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় চৌধুরী। অপরদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি" ১৮.৬%ভোটে ৮৮ টি (৮৩ সাধারণ + ৫টি। সংরক্ষিত নারী আসন) আসনে জয়ী হয়ে ২য় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নিচে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে প্রাপ্ত দল ভিত্তিক ভোটের হার উল্লেখ করা হলঃ
দলের নাম | পূর্ব পাকিস্তান | পশ্চিম পাকিস্তান | মোট আসন |
পূর্ব পাকিস্থান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৭০% ভোট লাভ করে। অর্থাৎ ৩০০টি আসনের মধ্যে সর্বমােট। ২৯৮টি আসন লাভ করে। যার মধ্যে ২৮৮টি সাধারণ আসন এবং ১০টি ছিল সংরক্ষিত নারী আসন।
নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
প্রথম সাধারণ নির্বাচন (first general election)
১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন।১৯৫৪ সালের নির্বাচন ছিল মূলত প্রাদেশিক নির্বাচন। ১৯৭০ সালে একই সাথে কেন্দ্রীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিপূর্ণতা লাভ(Plenitude of Bengali Nationalism)
(১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে তা আরও গতিশীল হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের রায়ের মাধ্যমে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে )
সংগঠন ও নেতৃত্বের বিকাশ(Development of organization and leadership)
১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলে আওয়ামী লীগ ও পি পি পি সমগ্র পাকিস্তানে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিতি পায় এবং শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৩ সাল ও জুলফিকার ভুট্টো ১৯৬৭ সাল থেকে নেতৃত্ব প্রদান করলেও প্রথম বারের মত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেন
পাকিস্তানের রাজনীতিতে আঞ্চলিক মনোভাবের সৃষ্টি (Creation of regional intention in Pakistan politics) :
(১৯৭০ এই নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আওয়ামীলীগ পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানে কোন আসন লাভ করতে সক্ষম হয়নি। একইভাবে, পাকিস্তান পিপলস। পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলেও পূর্ব পাকিস্তানে কোন আসনই লাভ করতে ব্যর্থ হয়। ফলাফলের এ ধারনার থেকে অঞ্চলভিত্তিক রাজনীতির স্পষ্ট রূপ পরিলক্ষিত হয়।)
পাকিস্তানের মৃত্যুর বার্তাবাহক(Messenger of the death of Pakistan) :
এ নির্বাচনের ফলাফলের সর্বাপেক্ষা উল্লেখ্যযোগ্য বিষয় হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে কোন আসন লাভ করেনি তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পি পি পি ও পূর্ব পকিস্তানে কোন আসন লাভ করতে সক্ষম হয়নি। এতে করে প্রতীয়মান হয় যে পাকিস্তানের এক অংশের জনগণ অপর অংশের জনগণকে সমর্থন করে না।যা পাকিস্তান বিভক্ত করনে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। এ কারণে ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে পাকিস্তানের মৃত্যুর । বার্তাবাহক বলে ধারণা করা হয়।)
। ৬-দফার গুরুত্ব প্রকাশ(Revealing the importance of 6-pc
1970 সালে নির্বাচনে পূর্বপাকিস্তানের। জনগণ ভোট দানের মাধ্যমে ৬-দফাকে স্বাগত জানায়। নির্বাচনের পূর্বে বঙ্গবন্ধু তার নির্বাচনী ভাষণে ৬-দফার উপর ভিত্তি করে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কথা উল্লেখ করে বলেন, “আগামী নির্বাচনে জাতীয় মৌলিক সমস্যাসমূহ বিশেষ করে ৬-দফার ভিত্তিতে আমরা সমাধানের পথ গ্রহণ করেছি।')
সংবিধান প্রণয়ন(Formulation of constitution)
১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রধান বিষয়বস্তু ছিল ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে দেশের ভবিষ্যৎ সংবিধান প্রণয়ন করা।তাই। নির্বাচনে জয়লাভের পর সরকার গঠনের পরপরই আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান প্রণয়নকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে । বিবেচনা করেন।)
ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিবাদ ('To protest the colonial rule) :
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকে পশ্চিম পাকিস্তান নানাভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করে আসছিল । রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসনিক থেকেই বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছিল পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তান অংশ পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবেই কাটিয়েছিল। ১৯৭০ এর নির্বাচনের অসাধারণ ফলাফল ছিল তাই এই ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিবাদ স্বরূপ।
বাঙালিদের আত্মপ্রত্যয়(Self-confidence of Bengali) :
১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ পূর্ব বাংলার জনগণের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের চরম অবহেলা বাঙালিকে নতুন ভাবে রুখে দাড়ানোর প্রেরণা জোগায়। ১৯৭০ সালের এই সাধারণ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে বাঙালি আত্নপ্রত্যয়ী হয়ে উঠে।
আওয়ামী লীগের শক্তিশালী অবস্থান(Powerful position of awami league) :
শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের জনগণ এক ঐতিহাসিক রায় প্রদান করিয়াছে। তাহারা এক অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাহাদের এ রায় প্রদান করিবার অধিকার অর্জন করিয়াছে এবং অগণিত মানুষ বৎসরের পর বৎসর ধরে নিপীড়ন সহ্য করিয়াছে। আওয়ামী লীগের এই বিরাট বিজয় প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নিপীড়িত মানুষের বিজয়।আমরা আমাদের জনগণ, আমাদের ছাত্র, আমাদের শ্রমিক ও কৃষকদের ভালােবাসায় অভিভূত হইয়াছি। তাহারা এই বার যথাযথভাবেই ব্যক্ত করিয়াছে যে, আওয়ামীলীগ তাহাদেরই দল"।